গোপাল ভাঁড়কে যে কারণে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা

যিনি ভাঁড়, আমা’দের কাছে তিনিই তো গো’পাল। ভাঁড়ের অবয়ব মনে এলে তাই অবধারিতভাবে টাক মাথায় টিকিওয়ালা পেট মোটা দারুণ এক রগু’ড়ে লোকের চেহারাই ভেসে ওঠে বাঙালির চোখে। তার নাম অবশ্যই গো’পাল ভাঁড়।
হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড়ের নাম শুনেননি, বিশ্বে এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গো’পাল ভাঁড় ছিলেন মধ্য যুগের নদীয়া অঞ্চলের একজন প্রখ্যাত মনোরঞ্জনকারী। তার আসল নাম গো’পাল চন্দ্র প্রামাণিক।
তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়া জে’লার প্রখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ সভায় নিযুক্ত ছিলেন। রাজা তাকে সভাসদদের একজন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা ও জনগণের যাব’তীয় বিনোদনের আস্ত এক ভাণ্ডার ছিলেন বু’দ্ধিমান গোপাল। কিন্তু এত প্রিয় মানুষ হয়েও বাংলাতে তার ঠাঁই হয়নি; বরং দেয়া হয়েছিল ফাঁ’সির আদেশ!
তখন ছিল ১৭৫৭ সাল। তরুণ সিরাজ-উদ-দৌলা ওই সময়ে বাংলা প্রেসিডেন্সি (বাংলাদেশ ও পশ্চিমব’ঙ্গ), বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, জগৎ শেঠ, রায় দূর্লভ, উমিচাঁদসহ অনেকেই নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার অ’পচেষ্টায় লি’প্ত ছিলেন।
তারা প্রত্যেকেই তাদের হীনস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শর্তসা’পেক্ষে ইংরেজ বণিকদের স’ঙ্গে চুক্তি করেন। ঠিক ওই সময় কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবাব বিরোধী এই ভ’য়ংকর বলয়ে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের এই পরিকল্পনায় রাজসভার সবাই সমর’্থন করলেও শুধু একজন ব্যক্তি ‘না’ করলেন। আর তিনি হলেন গোপাল ভাঁড়।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে গো’পাল বললেন, ইংরেজরা গায়ে সুচ হয়ে ঢুকে কুড়াল হয়ে বের হবে। তাদের স্বার্থ-বিরোধী কাজ করলে সব উপকারের কথা ভুলে আপনাকে শূলে চড়াতে পিছপা হবে না।
সর্বোপরি বাংলার এমন সর্বনাশ না করতে গো’পাল বারবার অনুরোধ করলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে। কিন্তু রাজা তার কথায় কর্ণপাত করলেন না বরং তার সভাসদদের নিয়ে গোপালকে বিদ্রুপ করতে লাগলেন। কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে শর্ত দিলেন, গোপাল যদি নবাবকে মুখ ভেংচি দিয়ে আসতে পারে তবেই তিনি নবাবের বিরু’দ্ধে যাব’েন না।
কৃষ্ণচন্দ্রের শর্ত শুনেই গো’পাল হাঁটা শুরু করলেন মুর্শিদাবাদের দিকে। কিন্তু তাকে ভাগিরথী নদীর তীরে গড়ে ওঠা হীরাঝিল প্রাসাদে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না কিছুতেই। গোপাল বু’দ্ধি করেই এক প্রহরীর হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন। ফলশ্রুতিতে বিচারের জন্য নবাবের কাছে নেয়া হলো গো’পালকে।
পুরো ঘটনা শুনে নবাব বললেন, ‘তুমি কে, কেন এসেছো?’ গোপাল কোনো কথা না বলে নবাবকে মুখ ভেংচি দিলেন। নবাব রেগে গোপালকে আট’ক করলেন। বললেন, আগামীকাল তোমা’র বিচার হবে।
এরইমধ্যে গোপাল মীরজাফরকে চুপি চুপি বললেন, ‘আমি এসেছিলাম তোমা’দের ষড়যন্ত্র ফাঁ’স করে দিতে। কিন্তু কিছু বলবো না। কারণ এসব কথা ফাঁ’স করে দিলে কৃষ্ণচন্দ্রও ফেঁসে যাব’ে। নবাব তাকে সরিয়ে অন্য জনকে ক্ষমতায় বসাবেন। আমি চাই না কৃষ্ণচন্দ্র তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলুক। তিনি যে আমা’র অন্নদাতা।’
মীরজাফর তার এমন কথা শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন। মীরজাফর চক্রা’ন্ত করে গো’পালের ফাঁ’সির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু গোপালের মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। নবাব গোপালের মুখের দিকে তাকাতেই গোপাল আবারো ভেংচি দিলেন। এবার নবাব রীতিমতো ভাবনায় পড়ে গেলেন।
নবাব ভাবলেন, এ তো পাগল! তাকে ফাঁ’সি দেয়া ঠিক হবে না। নবাব গোপালকে মুক্ত করে দিলেন। দেশপ্রেমিক গোপাল ফিরে এলেন কৃষ্ণনগরে। যখন জানতে পারলেন কৃষ্ণচন্দ্র তার সি’দ্ধান্তে অটল গোপাল ঠিক করলেন রাজসভায় আর যাব’েন না। এমনকি রাজ্যেই আর থাকবেন না। অত্যন্ত ব্যথিত মন নিয়ে কাউকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে পরিবার নিয়ে রাজ্য ত্যাগ করলেন গোপাল ভাঁড়। এরপর থেকে সদা হাস্যময় গোপাল ভাঁড়কে বাংলায় আর দেখা মেলেনি।